গল্প- প্যালারাম

।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

 

প্যালারাম
-রাণা চ্যাটার্জী

 

 

“পারবো না আর বাজার আনতে,যা জুটবে সেটাই ভাইকে রান্না করে খাওয়াবে”রেগে বলল প্যালারাম।যদিও আদুরী, স্বামীকে প্যাংলা ডাকতেই অভ্যস্ত, নয় নয় করে নয় বছরের প্রেম শেষে বিয়ে বলে কথা তাই কি এতদিনের অভ্যাস ছেড়ে ওগো হ্যাঁ গো করা যায়। তাছাড়া ওই আদরের ডাক ছাড়া আরনয়তো বলবে কি!ওই তো ছিরি,দু খানা হাড় ছাড়া শরীরে অবশিষ্ট কিছুই নেই!

বিয়ের পাকা কথা বলার সময় হবু জামাইয়ের চেহারা নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল বাবার, মেয়ের ওই ডাগর শরীরের পাশে জামাইকে যদি পাট কঞ্চির মতো লাগে কি করে লোকজনকে পরিচয় দেবে! মা খান্তা দেবী অবশ্য ছেড়ে দেবার নন, মেয়ের মুখ চেয়ে একহাত নিয়েছিলেন স্বামীকে!”বলি হ্যাঁ গা,আদুরীর বাপ,বলি বিয়ের সময় পাহাড় প্রমাণ হুমদো তুমিটা তো তখন পুঁচকে আমি টাকে পটাতে দুবেলা ঘুর ঘুর,ঘুর ঘুর করতে তার বেলা আর এখন কিনা ব্যাঘাত দিচ্ছ!

যাই হোক বেশ ধুমধাম করেই চার হাতের মিলন হয়ে গেলো প্যলা ওরফে সুদর্শন ও আদুরীর। প্যালারামের শরীরের জুত না থাকলে কি হবে নামের মধ্যে বেশ জৌলুশ ছিল ওর। সত্যিই যেন সুদর্শন শব্দটাকে ব্যঙ্গ করতো ওর শরীর!এর জন্য অকালেই এই সুন্দর নাম হারিয়ে “প্যালা”তেই ডাক আটকে যায়, এ যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। হাড়ের ওপর চামড়া লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া দেখলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যেন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট!ঠিক যেন ভগবান বড্ড তাড়াহুড়োয় শৈল্পিক হাতে ফিনিশিং টাচ দিতে ভুলে গেছে শ্রীমান প্যালাকে!আদুরীর ভাই অবশ্য বলে ছিল ওরে দিদি, এ যে জাম্বু তো এক্কেবারে কাক তাড়ুয়া !আড়ালে বললেও শ্যালক ও এক পাল শ্যালিকারা যে তাকে নিয়ে বেশ মজা পায় তা অল্প হলেও বোঝে দায়িত্ববান জামাই বাবাজীবন প্যালা।

” বাজার আনতে পারবে না মানে কি কথা শুনি? দশ টাকা সাইজের রসগোল্লার মতো চোখ পাকিয়ে ঝাঁজ নিয়ে বলল আদুরী। দিদির বাড়ি আসছে কিনা সাধের ভাই, আহারে আমার সোনাটা,ছটা বোনের পর হয়েছে। দশ টা নয় পাঁচটা নয় সাধের একটা মাত্র ভাই আমার, বাড়িতে কত আদর ওর জানো”?

“হম, হম আদরে বাঁদর করে ছেড়েছো ওটা কে আর এখন আমার পেছনে বাঁশ দিতে ঘটা করে কিনা অতিথি আপ্যায়ন..” ভেংচি কেটে থামলো প্যালা!কি বললে অতিথি!!আমার ভাই এবাড়ির ঘরের লোক তাকে এমন বেইজ্জত!কোমরে আঁচল গুঁজে দশাসই গিন্নি এগিয়ে আসতেই না জানি বিপদ বাড়বে ভেবে কাছ থেকে সরে দাঁড়ালো। মোক্ষম চড় যদি ভুল করে একটা ধেয়ে আসে বিছানায় শুয়ে সাতদিন গোঙাতে হবে এই দৃশ্য মনে ভাসতেই মুখ বেঁকিয়ে একখানা কটা চটা থলে ঝুলিয়ে বাজার চললো শ্রীমান প্যালা থুড়ি সাধের জাম্বো।বারান্দা থেকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে আদুরী আবদারে “অ্যাই শোনো,ওপরে তাকাও একবার”,এরপর গালে পান ঠেসে হাসি মুখে বলল ,”কই গো বলছি কি, গলদা চিংড়ি,ইলিশ আর ওই স্পেশাল দই এক কেজি এনো কেমন ফেরার পথে”।

মাঝে মাঝে বর টাকে আদুরীর বর্বর মনে হয়,আর লাগবে নাই বা কেন যেটা সে বলবে উনি ঠিক তাল কেটে তার উল্টো পথে হাঁটবে! কত্তা বাজার যেতেই মনটা ফুরফুরে হলো আদুরীর।ঘরের চাদর গুলো পাল্টে আর কুইন্টাল খানেক ময়লা বসা পর্দা গুলো টেনে নামালো।ভাবলো যাক আজ বর কে যা বলবো শুনবে মনে হচ্ছে ঝাড় খেয়েছে যা!

বউয়ের সামনে কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ফুঁসছে প্যালা, এই তো সেদিন ভাইফোঁটায় এলো শ্যালক, গনডে পিনডে গিলে জামাইবাবুর বুক শুকনো করে পাঁচদিন কাটিয়ে গেল, আবার আসার কি আছে শুনি! যা হয় হোক বাড়িতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ লাগুক, কিছুই আনবো না বলে আড়াইশো চারা পোনা, কচু, লাউ শাক এইসব হাবিজাবি কিনে ব্যাগ ভরে ফিরলো।

বাথরুমে প্যালা হাত- পা ধুতে যেতেই বাজার দেখে তো আদুরীর চক্ষু ছানাবড়া। মাথায় ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে তার ,কিন্তু না ওর মতো বেয়াদপ লোককে চিৎকারে মোটেও শায়েস্তা করা যাবে না, দিতে হবে মোক্ষম দাওয়াই ভেবে চুপচাপ বেডরুমে খিল তুলে দিলো। আদুরী আজ কত সখ করে বসে ছিল ভাইয়ের জন্য দুপুরেই দুটো পদ বানিয়ে রাখবে! সন্ধ্যায় ইউটিউব দেখে শেখা স্পেশাল টিফিন এর আয়োজন চলছিলো সব দিলো পণ্ড করে মর্কটটা,কিন্তু রাগ তো প্রকাশ করা তার ওপরই সাজে যে গুরুত্ব দেয়!দুঃখ হলেও মনে মনে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলো আদুরী।

“কই গো রাঁধবে না,বেলা যে যায় যায় গো, ও আমার আদুরী,সুর নরম করে হেঁকে চলেছে কত্তা। ভেতরে ভেতরে বেশ বুঝছে প্যালা, এই রে বেশ তো হলো দুপুরে কি খাওয়া জুটবে না,তবে তো কপালে বেশ দুঃখ আছে!ওদিকে বিকাল হলেই নাকি শালা বাবু হাজির হবেন আর ওর সামনে হাসিখুশি সুখী দম্পত্তির অভিনয় করতে হবে ভেবেই মুখটা বাংলা পাঁচের মতো বেঁকে গেলো প্যালার। গিন্নির মুখ ঝামটা,অপমান যা কিছু সব হজম করতে পারলেও কিছুতেই খিদেটা সহ্য হয় না প্যালার কিন্তু উপায়ই আর কি তার!!

সব বুঝেও কিছুতেই সাড়া দিলো না আদুরী,দরজা তেমনই বন্ধ।যেমন হাড় জিরজিরে সোয়ামি তেমন হাড়কেপ্পন লোক ,নে এবার ঠ্যালা সামলা বলে বন্ধ ঘরে আগে থেকে মজুত রাখা চিড়ে,কলা, গুঁড়ো দুধ মেখে পেট পূজা সারলো আদুরী । মনে মনে ভাবলো যেমন হাবিজাবি জিনিস নিয়ে ফিরেছো আমায় জব্দ করতে এবার বোঝো কত ধানে কত চাল।বেকার চিৎকার ঝগড়া না করে এভাবেই শায়েস্তা করার রাস্তা বুদ্ধিমতীর মতো বেছেছে আদুরী।

খিদেতে পেট চুঁই চুঁই প্যালার।ধুস,মশার কামড় গোটা দুপুর জুড়ে,কেবল জল খেয়ে খালি পেটে কি ঘুম সম্ভব!একবার ভাবছে রান্না ঘরে যে কিছু বানিয়ে নেবে সে তো সামান্য গ্যাস পর্যন্ত জ্বালতে জানে না!পরক্ষনেই মায়া হচ্ছে আহারে আদুরী টা না খেয়ে পড়ে আছে অথচ কি আর সে করতে পারে ভেবে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগলো প্যালার!

“ও বউ খোলো দরজা, প্রমিস করছি,বাজার আনবো বিকালেই।এই বারটার মতো মাফ করো আমায়।কই গো,সাড়ে তিনটা যে বাজলো,সেই সাড়ে নটায় সামান্য শসা মুড়ি!তোমারও যে শরীর খারাপ হবে”!

তৃপ্তি করে খেয়ে ঘুমটা এসেছিল আদুরীর ,স্বপ্ন দেখছিল প্যালা এক খানা প্রিন্টেড লুঙ্গি কেটে ফতুয়া বানিয়ে নিজেকে ঘন ঘন আয়নায় দেখছে।ইস আদিখ্যেতা! একখানা হিরো হিরো লুক দিয়ে ঠোঁটের কোণে সে যে কি মুচকি হাসি!কিন্তু প্যা লা ওটা কি পড়েছে নিচে! খুব যেন চেনা লাগছে আদুরীর।কাছে গিয়ে যেই দেখছে তার হারিয়ে যাওয়া নতুন সায়াটাকে মহান প্যালারাম মাঝ বরাবর সেলাই করে পাজামা বানিয়েছে! দেখে তো আদুরীর মাথাটায় আগুনটা আবার জ্বলে উঠলো ! দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বলে ঘুমের ঘোরেই ধরফর করে উঠে দরজা খুলে কলতলায় রাখা এক বালতি জল প্যালার মাথায় ঢেলে দেয় আদুরী।এই রে এ কি করলো সে, তার তো দরজা না খুলে তেজ দেখানোর পর্ব চলছিল! প্যালা তো তার কিনে দেওয়া বারমুডা তে !তবে কি ওটা স্বপ্ন দেখছিল আদুরী ভেবে লজ্জায় পড়লো।

খিদেতে কাতর ,ক্লান্ত আমআঁটির মতো শুকনো মুখে ঘুমিয়ে পড়া প্যালারাম রীতিমতো জলের ধাক্কায় ঘাবড়ে বাবাগো মেরে ফেললো আমায় বলে পাঁচিল টপকে দৌড়! বাইরে বেরিয়ে হকচকিয়ে ভাবছে প্যালা, বউ এই বুঝি আজ তাকে বালতি দিয়ে মাথা ফাটিয়েই দিতো!বড্ড অসহায় মুখে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে উঠলো সে।পাশের বাড়ির রাঙা ঠাম্মা ইয়ার্কি ছলে বলে উঠলো,” আহারে নাত বৌমা ভালোবাসায় বুঝি ভিজিয়ে দিলো প্যালা রামকে..”! বলেই ফিক কিরে হেসে উঠলো।দূর ছাই জীবনটা আলু ভাতের মতো চটকে দিলো সব্বাই,এমন মুখ করে কেন্নর মতো গুটি সুটি মেরে উঠানে ঢুকলো। হাত জোড় করে দরজা থেকে বলে ওঠলো,” মারিস নি রে বউ, দয়া করে মারিস নে, আমি আজই বিকালে বাজার করে আনবো”।আদুরীর ঘুম তো একদম চলে গেছে,সে হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছে না।একটু হলেও এবার তার প্যালার ওপর মায়া যে হচ্ছে না, তা নয় কিন্তু এখনই বেশি নরম হওয়া বুমেরাং হয়ে না যায় তাই গম্ভীর ভাব বজায় রেখে ঘরে ঢুকলো।

রাগ পুষে আদুরী ঘুমিয়ে যেতে স্বপ্ন যে হানা দিয়েছিল তার মাথায় বিলক্ষণ বুঝে ফিক করে হেসে ফেললো আপন মনে।এমন এক
উদ্ভট ড্রেসে তাবলে প্যালা কে কিনা দেখবে কোনোদিন ভাবেনি যে!এরপর রান্না ঘরে ঢুকে স্বামীর জন্য একটু গরম সুজি বানালো,বিকেল তখন গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নামার মুখে। প্যালা কোনো কথা না বাড়িয়ে সুরুৎ করে খেয়ে বাজারের ব্যাগ নিতে যাচ্ছিল দেখে চড়া গলায় আদুরী আদেশের সুরে বলে উঠলো:

“ভাইকে তার পছন্দের যা যা খাবার খেতে চায় সেই মতো সব কিনে ঘর ঢুকতে বলেছি ,যা বিল হবে তোমার একাউন্ট থেকে অনলাইন ব্যাঙ্কিং করে আমি ওকে মিটিয়ে দেবো”
শুনে তো আত্মারাম খাচাঁছাড়া হওয়ার উপক্রম প্যালার! মনে মনে ভাবলো উফ কি জন্য যে অনলাইন ব্যাঙ্কিং না শিখে আদুরীর ওপর ভরসা করেছি,শুধুই শাড়ির অর্ডার আর লাইভ দেখার ধুম আর আজ কিনা আরও এক কদম ! অমনি চেনা গলায় ভূমিকম্পের মতো গম গম পুরুষ কণ্ঠের হাঁক,” দিদি, জাম্বো দরজা খোলো.”.!

ওই শ্যালক হাজির তবে!…হাসি হাসি মুখের অভিনয় করে জাম্বো এক ছুটে দরজা খুলে দেখে একা নয়,তার সাধের ,পেছনে কাঠি দেওয়া শালা বাবু সঙ্গে মেয়েদের মতো এক মাথা ঘন লম্বা চুলে কানের দুলে সজ্জিত এক বন্ধুকেও দিদির বাড়ি হাওয়া বদল করাতে সটান হাজির করেছে।”উহু চোরের মতো মুখ করে ঘুরবে না একদম সামনে”আদুরী চাপা গলায় বলে ভাইয়ের কিনে আনা খাবারের বিল টা প্যালার হাতে গুঁজে দিলো।সারাদিন শসা মুড়ি আর বিকালে পাতলা সুজি খাওয়া প্যালার হৃৎপিন্ডটা বত্রিশ শো টাকার খাওয়ার বিল দেখে কেমন যেন চুপসে গেল!

Loading

Leave A Comment